বাংলাদেশ ও একজন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী
ব্রাসেলসে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সঙ্গে কী ঘটেছে তা জানার পর বিন্দুমাত্র দেরি না করে তিনি বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা ও ড. ওয়াজেদ মিয়াকে সূদুর জার্মানি থেকে গাড়ি পাঠিয়ে তাঁর বাসভবনে নিয়ে আসেন।
——————
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সময় শেখ হাসিনা, তাঁর স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া ও আদরের ছোট বোন শেখ রেহানা ছিলেন বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে। হত্যাযজ্ঞের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যার পাশে কোন প্রবাসী বাঙালিই এগিয়ে আসেনি। শুধু কি তাই! বেলজিয়ামের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হক বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিবারের জীবিত সদস্য যারা ভিআইপি প্রটোকলে ব্রাসেলসে ছিলেন- তাঁদেরকে ন্যায্য সহযোগিতা, এমন কি মানবিক বিবেচনায় হলেও কোন সাহায্য করতে অস্বীকৃৃতি জানায়। অথচ এই সানাউল হককে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব স্নেহ করতেন এবং নিজ পছন্দে তাঁকে বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেছিলেন!
অনেক কূটনীতিক চাকরি বাঁচাতে বঙ্গবন্ধুকন্যাদের এড়িয়ে চলা শুরু করলেও সব ভয়কে তুচ্ছ করে এগিয়ে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচরদের একজন।
মুক্তিযোদ্ধা। স্বনামধন্য কূটনীতিক। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতে তৎকালিন বাংলাদেশ মিশনের প্রধান থাকা অবস্থায় তিনি ৪০টিরও বেশি দেশে কুটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছিলেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্যে। যাঁরা বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে সম্মানের সাথে উপস্থাপন করেছেন তাঁদের মধ্যে অগ্রপথিক বিবেচিত হন যে মানুষটি, বিরুদ্ধ সময়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যাদ্বয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সেই হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীই।
তিনি তখন জার্মানির রাষ্ট্রদূত। ব্রাসেলসে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সঙ্গে কী ঘটেছে তা জানার পর বিন্দুমাত্র দেরি না করে তিনি বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা ও ড. ওয়াজেদ মিয়াকে সূদুর জার্মানি থেকে গাড়ি পাঠিয়ে তাঁর বাসভবনে নিয়ে আসেন। তিনি একটিবারের জন্যেও চিন্তা করেননি যে, এর জন্যে হয়তো তাঁকে জীবনে কঠিন মূল্য দিতে হতে পারে। হয়তো নিজের জীবনই হারাতে হতে পারে তাঁকে। কিন্তু তিনি ছিলেন অটল। নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন হতে এক মুহূর্তের জন্যেও পিছপা হননি।
বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যার নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বঙ্গবন্ধুর ঘাতক খন্দকার মোশতাক ক্ষিপ্ত হয়ে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে চাকরিচ্যুত করেন। মোশতাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবু সাঈদ চৌধুরী, তাঁকে ফোন করে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে এমন আশংকার কথা জানিয়ে বাংলাদেশে না আসার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রাণের ঝুঁকি উপেক্ষা করে, যাবতীয় প্রতিকূলতা পায়ে দ’লে ন্যায়ের পক্ষে যিনি থাকেন অবিচল- তিনি যে আলোকিত মানুষ! তাঁকে হেয় করে সাধ্য কার! উল্টো বাংলাদেশকে এক অনন্য গৌরবের উপলক্ষ এনে দিয়েছিলেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। সফল এই কুটনীতিক ১৯৮৫ সালের ৩ জুলাই জাতিসংঘের ৪১তম সাধারণ পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন।
তবে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বাংলাদেশকে চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে ফেলেন সেই পঁচাত্তর সালেই। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তিনি যেন বাঁচিয়ে রেখেছিলেন বাংলাদেশের ‘আশার প্রদীপ’। নির্মম সেই হত্যাযজ্ঞের ছ’বছরের মাথায় পিতার রক্তের স্রুতধারায় স্বদেশে ফেরেন শেখ হাসিনা।দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধুর হাতেগড়া সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের।
স্বদেশের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের লড়াই শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। আর সেই লড়াইয়েও যোগ দিয়েছিলেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। সিলেটের এই কৃতিপুরুষ ৭ মে ১৯৯৫, শেখ হাসিনার হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।